আমি টিভিখোর। সুযোগ পেলেই চট করে টিভির সামনে বসে পড়ি।
ভুল বললাম। বসতাম। ৭ বছর আগে, এখন নয়।
বা বসলেও নিজের পছন্দের কিছু দেখতে বসি না। এখন টিভিতে একটাই প্রোগ্রাম চলে বাড়িতে, সেটা হল নানাবিধ কার্টুন। যখনি বসি, ওগুলোই দেখি বা দেখতে বাধ্য হই। কোন উপায় নেই।
যাই হোক, ভগবান বলে কোন এক ভদ্রলোক নিশ্চয় ঘাপটি মেরে কোথাও বসে বসে আমার ওপর হয়ে চলা এই নিরন্তর অত্যাচার দেখে মজা লোটেন। কখনো সখনো ক্লান্ত হয়ে অবশ্য আমায় সুযোগ করে দেন যাতে কার্টুন ছাড়াও অন্য কিছু দেখতে পাই।
তো আজ এরকমই একটা দিন ছিল। বড়টা স্কুলে গেছে, ছোটটা পরম নিশ্চিন্তে যোগনিদ্রায় রত, এরকম এক মহাসময়ে আমি সেই ভগবান ভদ্রলোকটিকে 'থ্যাংকু', 'শুক্রিয়া', 'আরিগাতোগোজাইমাসিতো', 'ডাঙ্কে' ইত্যাদি ইত্যাদি নানান ভাষায় ধন্যবাদজ্ঞাপন করে বেশ জুত করে টিভি খুলে বসলাম।
মনে পড়ে গেল স্কুলের সময়কার কথা। তখন হয় টিভি খুলে লুকিয়ে এফ টিভি দেখতাম, কিংবা শক্তিমান দেখতাম দূরদর্শনে।
সে যাই হোক এখন বয়স হয়েছে। বেশি নয়, তাও হয়েছে তো! এমনি এমনি তো আর চুল পাকেনি বা দুই সন্তানের পিতৃত্ব লাভ করিনি। তাই আর আগেকার মত এফ টিভি খোলার চেষ্টা করলাম না। সত্যি বলতে কি চ্যানেলটা এখন আছে কিনা, সেটাও জানি না।
তো মোদ্দা কথায় আসি। প্রথমেই একটা বাংলা চ্যানেল খুললাম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
স্টার জলসা - একটা সিরিয়াল হচ্ছিল, নাম জানি না, জানতে চাইও না। এককালে জননী, জন্মভূমি এই সিরিয়াল গুলো ঠাকুমার সাথে বসে দেখতাম। তো ভাবলাম দেখি এই সিরিয়ালটা কেমন?
ভুল, ভুল । সিদ্ধান্তটা যে একদম ঐতিহাসিক ভুল ছিল, তা একটু পরেই বুঝলাম।
গল্প টা যেটুকু বোঝা গেল, তা হল এক শহুরে, নামজাদা চিকিৎসক পাকে চক্রে একটি গ্রাম্য , সহজসরল মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু সেই বউটি তার পরম ভালোবাসার বরকে অন্য একটি মহিলার সাথে বিয়ে দিয়ে আত্মবলিদান করতে বদ্ধপরিকর কারণ ওই মহিলার হবু স্বামী সেই অভাগা ডাক্তার বরটির চিকিৎসায় মারা গেছে।
তা কুকুরের পেটে যেমন ঘি সহ্য হয়না, তেমনি আমার মত পাপিষ্ঠের পক্ষেও এই মহানতা আত্মস্থ করা সম্ভব হলনা। কেউ প্ল্যানচেট করতে পারলে জানাবেন, গান্ধীজি, বিদ্যাসাগর মশাই কিম্বা রাজা হরিশ্চন্দ্র হয়ত এই সিরিয়ালটা দেখলে কিছুটা শিক্ষালাভ করতে পারবেন।
সুতরাং রিমোটে চ্যানেল ঘোরালাম।
সিনেমার একটা চ্যানেলে - সেটম্যাক্সে অমিতাভ বচ্চনের অস্কারজয়ী সূর্যবংশম দেখচ্ছিল। শুনেছি এই চ্যানেলে ২টোই প্রোগ্রাম দেখায় - আইপিএল আর সূর্যবংশম। তা এই সিনেমাটা এককালে আধা অবধি দেখে সারাদিন হেঁচকি তুলেছিলাম। আর কোনমতেই সেই অভিজ্ঞতা চাই না । তাই হ্যাচোরপ্যাচোর করে তৎক্ষণাৎ চ্যানেলটা বদল করলাম।
পরের চ্যানেলটায় দেখলাম আমাদের এক মহানায়ক কাম বিধায়ক মশাই নেচে গেয়ে গান করছেন, সাথে আবার দুষ্টের দমনও করছেন একিসাথে। সিনেমাটার নাম বোধহয় পাগলু২।
আহা, জল চলে এল চোখে. কিন্তু ওই আর কি, বেশি জল পড়লে আবার ডিহাইড্রেশন না হয়ে যায়, সেই ভয়ে পরের চ্যানেলটা চালিয়ে দেখি আমাদের 'চন্দননগরের মাল' তাপসদা আর 'বেল্ট কাকু' রঞ্জিত মল্লিক নিজেদের মধ্যে উচ্চকিত ভাবে চোখা চোখা বক্তব্য রাখছেন।
কার পক্ষ নেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একেই মনে হয় বলে ডাঙ্গায় বাঘ আর জলে কুমীর। তাপসদা কে সাপোর্ট করলে গায়ের মধ্যে ঝপাং ঝপাং করে বেল্টের বাড়ি পড়ার প্রবল সম্ভাবনা। আর মালদার বিপক্ষে গেলে তো ঘরে ছেলে ঢুকে পড়বে !!!
কি দরকার রে ভাই এত ঝামেলায় জড়িয়ে !! ভয়ে কাপতে কাপতে তাপসদা আর রঞ্জিত কাকুর রক্তচক্ষু এড়িয়ে চ্যানেল বদলালাম।
পরের গন্তব্য - স্টার স্পোর্টস।
তা সেখানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের রেকর্ডিং চলছিল।
বুমরাহর নো বল টা আবার দেখার সৌভাগ্য হল। কিন্তু জেনেশুনে বিষপান করার জন্যে অনেক সময় আছে ভবিষ্যতে, এই ভেবে রিমোট চাপতেই শরীরটা ব্যাথা করে উঠল।
কারণটা আর কিছুই নয়, ওখানে ডব্লু ডব্লু এফের খেলা চলছিল। এই খেলাটা আমার দেখতে অতটাই ভাল্লাগে যতটা ভাল্লাগে কাজের মাসিদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়াগুলো শুনতে।
যাই হোক , নিজের শরীরের কথা ভেবে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত চিত্তে এই অত্যন্ত ভাললাগার খেলাটা দেখার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম।
পরের চ্যানেলটায় চলছিল গল্ফ। কখন হোলে বল পড়বে, তার জন্যে বসে থাকলে তো কলিযুগ পেড়িয়ে সত্যযুগ এসে পড়বে।
তাই আর বিন্দুমাত্র কালবিলম্ব না করে চলে গেলাম সংবাদের চ্যানেল গুলোয়।
সংবাদের চ্যানেলগুলোর মধ্যে এনডিটিভি আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিল এককালে। সেই ওয়ার্ল্ড দিস উইক' এর সময় থেকেই প্রণয় রায়কে বেশ ভাললাগত। তা সেই এনডিটিভি খুলতেই দেখলাম বেশ কিছু দাড়িওয়ালা বোদ্ধা টাইপের লোকজন বসে বেশ গুরুগম্ভীর আলোচনা করছেন।
খানিক্ষন বাদে বুঝলাম তারা জনৈক পশুপ্রেমীদের নিয়ে কথা বলছেন। আরো জানলাম যে সেই পশুপ্রেমীরা বেশ রবিনহুডের মতন। তারা পশু বাচাতে মানুষ মেরে দেয়। আরেব্বাস !!! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
এরা তো তাহলে একদম যাকে বলে বিবেকানন্দের ভাব শিষ্য। 'জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর'। তবে তা করতে গিয়ে কয়েকটি মানুষই তো মেরেছে মাত্র, কি আর এমন দোষ!
আমি আবার পশুপ্রেমীদের হেব্বি ফ্যান ছিলাম একসময়।
তাই তাদের গালমন্দ করলে আমি খুব দুঃখ পাই।
কি আর করি, মনে এক রাশ দুঃখ নিয়ে পরের চ্যানেলে যেতেই মনে হল যেন ভূমিকম্প হল।
চেয়ার থেকে পড়েই যেতাম। কোনমতে হাতল টাতল ধরে সামলে উঠে দেখলাম যে কালো স্যুট পড়া, চশমা পরিহিত এক ভদ্রলোকের গলা থেকে এই ভূমিকম্প উদ্রেককারী আওয়াজ খানা বেরোচ্ছে।
সুকুমার রায়ের কবিতাখানি মনে পড়ে গেল -
' ভীষন রবে গান ধরেছে ভীষ্মোলোচন শর্মা, আওয়াজ খানা দিচ্ছে হানা দিল্লি থেকে বর্মা।'
একটু পরে বুঝলাম যে চ্যানেলটি হল রিপাবলিক টিভি আর সেই সঞ্চালক মশাই হলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী অর্ণব গোস্বামী। বাজখাঁই গলায় কাকে যেন ধমকাচ্ছিলেন গোস্বামীবাবু।
ভাল করে শুনতে বুঝলাম সেই লোকটি, যিনি ধমক খাচ্ছিলেন, তিনি কিছু অতীব নির্বিরোধী, শান্তিকামী মানুষদের শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সমর্থন করছিলেন বলেই ধমক খেয়ে চমকে চমকে উঠছিলেন।
তা হয়েছিল কি, একটি কিশোর বালক নাকি একটি মুখপুস্তকে সর্বধর্ম সমন্বয় টাইপের একটি শান্তির বাণী ছেড়েছিল। সেই বাণী পড়ে কিছু ঘোরতর নির্বিরোধী, শান্তিকামী মানুষ নাকি এতই আনন্দিত হয়েছিলেন যে তাঁরা আবদার জুড়েছিলেন যে সেই কিশোরটির সাথে পাথর ছুড়ে ছুড়ে ডাংগুলি খেলবেন। কিন্তু ওনাদের সেই আবদার না মানায় ওনারা তার পরিবর্তে কিছু অত্যন্ত গঠনমূলক কাজে নিজেদের লিপ্ত করেন - এই যেমন ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সাধারণ লোকজন কে আদর করে তাদের হাত-পা-মাথা ফাটিয়ে দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওই আর কি, আগেই বলেছি বয়সের ভারে জর্জরিত আমি, তাই আমার মস্তিষ্কের প্রোসেসরটা আগের মত অত সক্ষম নয়। এত কিছু তথ্য প্রোসেস করতে গিয়ে মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছিল।
কোনমতে মুখে - মাথায় জলটল ছিটিয়ে আবার রিমোট টিপলাম।
সামনে দেখি ডিজনি চ্যানেল। সেখানে চলছে টম এন্ড জেরির কার্টুন। আদি অনন্তকাল যাবৎ চিনি এদেরকে। একটি বিচ্ছু বিড়াল আর একটি ততোধিক বিচ্ছু ইদূরের নিজেদের মধ্যে লাভ-হেট রিলেশনশিপের কাহিনি। সারাক্ষণ মারামারি করে কিন্তু তারি মধ্যে ওরা কিন্তু একে অপরকে ভালোওবাসে, কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেও পারে না.
দেখতে দেখতে মনে হল এই কার্টুনই তো ভাল। যেখানেই তাকাই সর্বত্রই তো এই কার্টুনগিরির খবরই দেখি।
ইন্ডিয়া পাকিস্তানি হোক বা ঘটি বাঙ্গালই হোক বা হিন্দু মুসলমানই হোক সর্বত্রই এই টম এন্ড জেরির গল্পই চলছে। মারামারিও করব আবার কেউ কাউকে ছাড়া থাকতেও পারব না।
ভাবুন তো একটা সমাজ যেখানে কোন একটি বিশেষ গ্রুপ আর নেই। আরে বাবা ঝগড়া করতেও তো পার্টনার লাগে, তাই না?
যাই হোক, শেষে বুঝলাম যে আমাদের দুনিয়াটাই যেখানে কার্টুন , তখন কার্টুন চ্যানেল দেখাই শ্রেয়।
তাই শেষ অবধি ডিজনি চ্যানেলটাই দেখলাম।
হরেক রকমের কার্টুন হল - টম এন্ড জেরি, ডোরেমন, মিকি ডোনাল্ড। প্রাণ খুলে হাসলাম, একদম নির্মল আনন্দ উপভোগ যাকে বলে।
কারোর চাপে নয়, একদম নিজের ইচ্ছায়। আরো চাইলাম যে আমার সন্তান যেন চিরটাকাল এরকম কার্টুন দেখেই নির্মল আনন্দ পেতে পারে।