এবারের কলকাতা বইমেলা থেকে যে বইগুলি কিনলাম, সে সবকটাই তথাকথিত 'ফেসবুক লেখকদের' প্রকাশিত বই।
আরো একটি মিল আছে বইগুলির মধ্যে। সেটা হল প্রতিটি বই ই অনেকগুলো অণুগল্পের সমাহার ।
আমার আজকের লেখা এই বইগুলি নিয়েই।
১. আমার রাত্রিসুখ (লেখক - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়)
যা ভাল লেগেছে - প্রতিটি গল্পই খুব যত্ন সহকারে লেখা। একদিকে আছে যেমন লেখকের লেখনীর মুন্সিয়ানা, অন্যদিকে তেমন রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের নানান গল্প। ভৌতিক, রহস্য-রোমাঞ্চ, প্রেম, কল্পবিজ্ঞান, মজাদার, মর্মস্পর্শী - এত বাহারি স্বাদের গল্পের চমৎকার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন লেখক।
যা আরো ভাল লাগতে পারত - বইয়ের নাম। যারাই বইয়ের মলাটটা দেখেছে ভেবেছে কোন নিষিদ্ধ বই পড়ছি। প্রথম গল্পটিও অতটা টানেনি আমায়। কিন্তু তারপর থেকে একদম ছক্কার পর ছক্কা। তবে লেখক নিজে ডাক্তার বলেই হয়তো গল্পগুলির মধ্যে প্রায়শই ডাক্তারি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
মতামত - সব মিলিয়ে 'আমার রাত্রিসুখ' এবারের বইমেলায় আমার অন্যতম সেরা ক্রয় ।
২. মার্কেট ভিজিট (লেখক - অভীক সরকার )
এই বইটি হল জন্ম থেকে সেলসম্যান - অভীক সরকারের দেশ বিদেশের নানান সেলস অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ।
যা ভাল লেগেছে - কত অভিজ্ঞতা রে বাবা!!! বেশির ভাগ গল্পই মজাদার কিন্তু সাথে আবার একটি ভৌতিক ও আছে। কিছু গল্প আবার সমাজের ভন্ডামি চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়।
তবু বলব বৈচিত্র্য নয়, এই বইয়ের প্রধান আকর্ষণ হল লেখকের লেখনশৈল্পী। সে ভাষাই হোক বা লেখার পরতে পরতে রঙ্গ ব্যঙ্গ, সব মিলিয়ে অভীকবাবুর লেখা একটা মায়াজাল সৃষ্টি করেছে।
যা আরো ভাল লাগতে পারত - অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে বৈচিত্র্য একটু কম। মানে একটু প্রেম-টেম, পরকীয়া-টরকীয়া থাকলে আরেকটু জমে যেত আর কি !!! তবে যেচে কে আর বউয়ের মার খেতে চায় !!!
মতামত - যারা বাঙলা ভাষার স্বাদ নিতে ভালবাসেন তাঁরা এই বইটিকে অবশ্যই চোখ, কান, নাক বা আরো যা যা আছে, সব বুজে কিনে ফেলুন। ঠকবেন না গ্যারান্টী।
৩. শান্ত (লেখক - রাজা ভট্টাচার্য )
যা ভাল লেগেছে - রাজা ভট্টাচার্য সৃষ্ট একটি অনন্যসাধারণ চরিত্র এই শান্ত, যে হাসি মুখে আমাদের দৈনন্দিন ছোট বড় সমস্যা থেকে শুরু করে নানাবিধ সামাজিক ব্যধির সমাধান করে দেয় তার নিজস্ব উপায়ে।
লেখকের নিজের ভাষায় - 'আমাদের সকলের মধ্যে একটা করে শান্ত আছে। সুযোগ ও সাহসের অভাবে তা সামনে আসে না অধিকাংশ সময়ে। '
আশা রাখি রাজাবাবুর সহজ, সরল, ঝরঝরে ভাষায় লেখা শান্তর কাহিনী পড়ে আমাদের মধ্যেকার সেই মানবিক মানুষটা বেড়িয়ে আসবে সময়ে সময়ে।
যা আরো ভাল লাগতে পারত - কয়েকটি গল্প একি ধাঁচের । কিছু গল্প পড়ে মনে হয়েছে যেন একটু জোর করে হাসানোর চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেগুলি সংখ্যায় নগন্য।
মতামত - শান্ত পড়ুন। একবার শান্তর সাথে আলাপ করে ফেললে ওকে ভালবেসে ফেলবেনই, কেউ আটকাতে পারবেনা !!!
৪. বংপেন৭৫ (লেখক - তন্ময় মুখার্জ্জী) :
তন্ময় মুখার্জ্জীর ব্লগে প্রকাশিত ৭৫টি অণুগল্পের সংকলণ এই বইটি বইমেলায় পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। যখনি পত্রভারতীতে গেছি, শালারা বলে স্টক শেষ।
অবশেষে একদিন পেলাম আর পরে পড়তে গিয়ে বুঝলাম কেন এটা হটকেকের মতন বিকোচ্ছিল।
যা ভাল লেগেছে - স্টাইল, ভ্যারাইটি, কন্টেন্ট সবেতেই এ একদম যাকে বলে টপার। এই বইটা পড়ে আমি হো হো করে হেসেছি, চোখের জল ফেলেছি, ভয় পেয়েছি, প্রেমে পড়েছি, তবে সবচেয়ে বেশী যেটা করেছি তা হল - ভেবেছি। কত ভাবনার যে খোরাক পেয়েছি বইটা পড়ে তা বলে বোঝানো যাবে না। বিশেষত কল্পবিজ্ঞানের গল্পগুলো পড়লে লেখকের চিন্তাভাবনার গভীরতার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
যা আরো ভাল লাগতে পারত - কয়েকটি গল্প একটু বেশীই ছোট যাকে বলে অধিকাণু। সেগুলি পড়ে বোঝার আগেই শেষ। অনেকটা টি-টোয়েন্টী ম্যাচ দেখতে গিয়ে যদি দেখেন টি-ফাইভ ম্যাচ তাহলে যেমন লাগবে। উত্তেজনা হবে কিন্তু মন ভরবে না।
মতামত - বংপেন৭৫ কিন্তু একদম যাকে বলে খাঁটি সোনা। কিনুন, ধার করুন, চুরি করুন - কিন্তু বইটা পড়ুন।
সবশেষে বলি অণুগল্পের এই ধারা বাংলা সাহিত্যে যুগোপজয়ী হবে কিনা জানা নেই, কিন্তু আমি বা আমার মত অনেকেই আছে যারা এই অণুগল্পের মাধ্যমেই আবার বাংলা সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
ঠিক যেমন জীবনমুখী গান একসময়ের বাংলা সঙ্গীতকে নতুন দিশা দেখিয়েছিল, তেমনি কে জানে এই অণুগল্পই হয়তো বা বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ।