ঈদের সকাল।
আগের দিনই নেমন্তন্ন চলে এসেছে শাজাহানদার বাড়ি থেকে ।
শাজাহানদা আমার গাড়িচালক। তবে সত্যি কথা বলতে কি, ভদ্রলোক তার সাথে সাথে আমার গার্জেনগিরিও করে থাকেন সময়ে অসময়ে। আমাকে ভাই বলে ডাকে, আমার মা কেও মা বলেই ডাকে ।
তো সেই শাজাহানদার জীবনচরিত লিখতে বসলে মোটামুটি হলিউড না হলেও একটা বলিউডের সিনেমা তো বনেই যাবে।
খুব সংক্ষেপে সারি। ভদ্রলোক মুম্বতে গিয়ে হিরো হতে গিয়ে ফিরে এসেছিল টাকার অভাবে, তারপর সিপিএম এর গুন্ডা হয়ে বেশ কিছু খুনটুন করে জেল খেটে বেড়িয়ে এসে কিছুদিন পুলিশের সোর্স হয়ে কাজ করে অবশেষে এখন আমার গাড়িচালক প্লাস গার্জেন।
তো আগে যাই হোক, বিগত ৫ বছর ধরে শাজাহানদাকে দেখছি। প্রচন্ড ইমানদারি নিয়ে কাজ করা, সব ধর্ম মেনে চলা এক মানুষ। সত্যিকারের সেক্যুলার লোক, সেক্যুলারিজমের মুখোশ পড়া ভন্ড দেখনদারীওয়ালা নয়। শাজাহানদার সব ধর্ম মেনে চলার গল্পটা অন্য আরেকদিন বলবো, যথাসময়ে । আপাতত কালকের ঘটনাটাই বলি।
ঈদের নেমন্তন্ন যখন, তখন সাদা পাঞ্জাবি পড়ে যাওয়াটাই রেয়াজ সর্বত্র। কিন্তু আমার আবার রেয়াজ না মানাই অভ্যেস। তো সেই অভ্যেস মতই বেশ একটা লাল নীল সবুজ হলুদয়ালা রং বেরং এর টি-শার্ট পড়ে গেলাম শাজাহানদার বাড়ির লাগোয়া মসজিদের সামনে।
আমার পোশাক দেখে ওখানকার অনেকেই বেশ বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে আমার দিকে, আর আমি বেশ নির্বিকার চিত্তে ঢিনচ্যাক পূজা আর হানি সিং এর গান শুনে, তার তুলনামূলক শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ করে সময় অতিবাহিত করছি। হঠাৎ দেখি সামনে বেশ সাজো সাজো রব উঠেছে। তাকিয়ে দেখি একটা বেশ বড় কনভয় এসে দাড়িয়েছে। ভেতর থেকে নেমে এসেছেন জনৈক দাপুটে মন্ত্রী। সাথে বেশ কিছু ষন্ডামন্ডা দেহরক্ষী। তা তেনারা এসেই আমাদের মত আম জনতা কে ছত্রভঙ্গ করতে লেগে গেলেন।
আমিও সরে দাড়ালাম। স্বাভাবিক ভাবেই মসজিদের ভেতর থেকে দাপুটে মন্ত্রীবর কে অভ্যর্থনা জানাতে লোকজন বেড়িয়ে আসছে, হঠাৎ দেখি শাজাহানদাও বেড়িয়ে এল।
তা মন্ত্রীবাবু বেশ শাহরুখ খানের কায়দায় সবার সাথে হাত মিলিয়ে জাপ্টাজাপ্টি করছেন, কিন্তু শাজাহানদা দেখলাম কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ওনার সামনে দিয়েই বেড়িয়ে এল।
মন্ত্রীমশাই একটু অবাকই হলেন মনে হল। ওনার পাশে আবার ছিল আমাদের ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। তিনি তো বেশ রাগত ভাবেই পাশের এক বৃদ্ধ কে জিজ্ঞেস করলেন যে কে এই বেয়াদব লোক? বৃদ্ধের উত্তর শোনার আগেই অবশ্য শাজাহানদা আমায় পাকড়াও করে ফেলেছে। আর তারপর প্রায় চ্যাংদোলা করে বস্তির মধ্যে ঢুকিয়ে তার বাড়ি নিয়ে চলে গেছে।
একটু পরে মন্ত্রী মশাইও তার সিপাহী দের নিয়ে বস্তিতে ঢুকলেন।
সেখানেও সবাইকে দেখে তিনি একগাল হাসি হেসে 'ঈদ মোবারক', 'সালাম আলেইকুম' করে অনেককেই জড়িয়ে ধরে হামি টামি খেলেন।
একটু পরে শাজাহানদার বাড়ির সামনে এসেও অমায়িক হাসির সাথে কুশল বিনিময় হল। হঠাৎ ওনার চোখ গেল আমার দিকে।
মুশকিল হল এই মন্ত্রীমশাইকে আমি পারিবারিক সূত্রে ভালই চিনি আর উনিও আমায় অল্পসল্প চেনেন । তাতে অবশ্য কোনই অসুবিধে নেই।
অসুবিধেটা শুধু এই যে ওনার সামনেই শাজাহানদার বাড়ির লোকজন ওনার পরিচিত একজন আম আদমিকে সেমাই পায়েস পরিবেশন করলেন আর মন্ত্রীমশাই বা সেই কাউন্সিলর মশাইকে দেখে মাথা হেলিয়ে শুকনো অভিবাদন জানালেন।
বিশ্বাস করবেন না, সেই সময়ে কেউ যদি আমায় নিজের নাম জিজ্ঞেস করত, তো নির্ঘাত নরেন্দ্র মোদি বা প্রণব মুখার্জি বলতাম হয়ত, নিজেকে এরকম ভিভিআইপি কোন দিনও মনে হয়নি আগে।
আর শুধু যে শাজাহানদার বাড়ির লোকজন আমায় এত খাতিরদারি করল তাও নয়, চারপাশের আরো কত না চেনা, না জানা মানুষেরা এসে আমার সাথে হরেক কিসিমের গল্প করে গেল।
সেমাই তো খেলামি, সাথে ২ রকমের সরবত, বিরিয়ানি , মাছ , মাংস আরো কত কি !!!
ধর্মীয় বিভাজন, মৌলবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি যা দেখেছি সবই ভার্চুয়াল ফেবুর কল্যাণে, কিন্তু বাস্তবে ঈদের দিনে একটি মুসলমান বস্তিতে গিয়ে অনেকটা ভালবাসাই পেলাম, সাথে আশীর্বাদও।
এও দেখলাম যে সংখ্যালঘু তোষণকারী কোন এক দলের কোন এক দাপুটে মন্ত্রীর চাইতে কিন্তু অনেক বেশি আন্তরিকতা বরাদ্দ ছিল একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন অজানা, অচেনা হিন্দু ছেলের প্রতি।
জয় হিন্দ ।
No comments:
Post a Comment